Tuesday 8 July 2014

স্বর্গীয় সব খাবার দাবার

আজ না কিছু স্বর্গীয় খাবার-দাবারের কথা মনে পড়ছে থেকে থেকেই। না না 'খাই খাই' ঘটনাবলীর মত রান্না করতে গিয়ে ভুন্ডুল করে ফেলা একাকার ব্যাপার সাপার নয়। সত্যি সত্যি সব স্বর্গীয় ব্যাপার-স্যাপার। যেগুলো আমি এখনো হাতের কাছে পেলে পিত্জ্জা-পাস্তা কে ভুলে গিয়ে হামলে পড়ে খেয়ে ফেলতে পারি। ছোট বেলায় এরকম স্বর্গীয় খাদ্যবস্তু সবাই কম বেশি খেয়েছেন। হয়ত এইগুলোই খাননি, কিন্তু এরকমই ভয়ানক রকম ভালো ভালো খাবার নিশ্চয়ই খেয়েছেন। তবে কিনা এসব খাবার যেমন তেমন করে খেলে চলবে না। কিছু rules and regulations আছে। নইলে এসবের আসল স্বাদটা ঠিক বোঝা যায় না। সেই সব প্রোটোকল মেনে খেলে তো আহা...........।
আমি আমার ছোট বেলার এইসব অমৃতসম খাবারের কথা প্রোটোকল সমেত বলে যাচ্ছি, দেখুন দিকি আপনাদের প্রটোকলের সাথে মেলে কিনা?

গুঁড়ো দুধ: এটাই সবার প্রথমে আসে। আমি এখনো Nestle Everyday এর প্যাকেট কেটে কৌটোতে ভরার সময় কেউ দেখে ফেলার আগেই খানিকটা খেয়ে নি, তারপর যা করার করি। এবার খাবার প্রোটোকলটা বলি। এটা খেতে হয় চুরি করে। তাহলে আরো ভালো লাগে। আর এটা কে যদি বাটিতে নিয়ে চামচ দিয়ে না খেয়ে, এক খাবলা হাতের তালুতে নিয়ে চেটে চেটে খাওয়া যায় তবে তো অমৃত।
এটা এতবার এত রকম ভাবে চুরি করে খেয়েছি যে কি আর বলব। এমনকি দু চার বছর আগেও, আগেকার ল্যাবের tea-coffee ফান্ড থেকে সকলের চা কফি করার জন্য আনা গুঁড়ো দুধ গণ-হারে সবাই মিলে চুরি করে খেয়েছি। এই সময়টাতে লক্ষ্য করে দেখেছি যে, কারো সাথে কারো মন কষা কষি থাকত না। ছোটবেলায় ধরা পড়ে যেত চুরি, খেয়ে কৌটোর ঢাকনা ঠিক করে লাগাতাম না, মাটিতে ছড়াতাম। আর তারপর মা তার ভূমিকায় নেমে পড়তেন। বরাবরের হাঁদা তো। আমার এক দাদা শীতকালে চাদরের তলায় পুরো কৌটোটাই নিয়ে বসে গেছিল পড়তে। এবং যথারীতি এই ডাকাতিও ধরা পড়েছিল এবং তারপর যা হওয়া সম্ভব আন্দাজ করে নিন। যাই হোক না কেন এই বস্তুটি এই তালিকায় প্রথম স্থানে থাকবেই থাকবে আমার মতে।  

বাপুজি কেক: নেক্সট যেটা আসে সেটা হলো বাপুজি কেক। এখানে পাওয়া যায় না। খুব খারাপ। কলকাতায় থাকতেও খেতাম। সঙ্গে একটা কলা। প্রথমে আপনাকে তেল চুপচুপে কাগজটা ছিঁড়ে কেকটা ভেঙ্গে লাল হলুদ রং করা চেরি- মোরব্বার বিকল্প গুলো খুঁটে-খুঁটে খেয়ে নিতে হবে। তার পর বাকিটা। একবার মনে আছে মা- জেঠিমা, দিদি-দাদা, রাজ্য সুদ্ধু সক্কলে মায় বাবা পর্যন্ত আমায় বাড়িতে রেখে দিয়ে আমাদের গ্রামের পাঁচ টাকা টিকিটওয়ালা সিনেমা হলে কি এক মহার্ঘ্য সিনেমা দেখতে গেছিল। কি অমানবিক। আর আমি প্রচন্ড রাগে সারা সময়টা উঠোনে রাখা ক্যাম্প খাটে পাঁচিলের দিকে মুখ করে শুয়ে ছিলাম, যতক্ষণ না সিনেমার দর্শকরা ফিরে এসে আমার হাতে দু-দুখানা বাপুজি কেক ধরিয়ে দিয়েছিল। কি গাধাই ছিলাম ভাবা যায় না।  

মৌরি লজেন্স: এটা বেশ পাওয়া যায় সর্বত্র। আমি তো যেখানে পাই কিনে ফেলি। প্রথমে প্যাকেট বা কৌটো খুলে তিন চারটে একসাথে নিয়ে সোজা মুখে। তারপরে চুষে চুষে ওপরের মিষ্টি কোটিংটা গলে গেলে তারপর মৌরি গুলো। পরের বার কিন্তু ওরকম করে নয়, তখন পছন্দের রঙের একটা একটা করে নিয়ে কুট কুট করে দাঁতে কেটে এবং চুষে। আহহ। আর এর কৌটো গুলো কি সব দুর্দান্ত shape এর। কোনটা থাম্বস আপ এর মিনিয়েচার বোতল, কোনটা ব্যাং, কোনটা টিয়া পাখি........জাস্ট ছাড়া যায় না।   

কাঠি আইসক্রিম: এটা নিয়ে আর কি বলব? আমি আগেই বলেছি এটার কথা। কাঠির মাথায় কমলা, সবুজ, সাদা - নানা রঙের মিষ্টি রঙিন জল জমিয়ে বানানো স্বর্গের ঠান্ডাই আর কি। খেলে জিভ-টিভ সব রঙিন। আমাদের পাড়ার মোড়ে একটা আইসক্রিম তৈরীর ছোট ফ্যাক্টরি আছে। যার জন্য আমাদের পাড়ার গলির নামই হলো 'বরফকলের গলি'। এখন তাতে নানা রকম কায়দার আইসক্রিম পাওয়া যায়, যেগুলো সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো দুর্বলতা নেই। কিন্তু আজ থেকে বছর কুড়ি আগে সেখানে পাওয়া যেত শুধু বাজারের মাছে দেবার জন্য তাল তাল জমানো বরফ। যা বাজারের মাছবিক্রেতারা কিনতেন।এবং সঙ্গে পাওয়া যেত ওই 'জলবরফ', মানে কাঠির মাথায় মিষ্টি-মিষ্টি জল জমানো। দাম কুড়ি পয়সা। বেশ কিছু বছরের নিষেধাজ্ঞার পর একটু বড় হয়ে আমার মাঝে মাঝে ওই জলবরফ চোষার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে আমি কিনা ভালো মেয়ে তাই সাদা রঙের জলবরফই কিনতাম আর রুমা যদি কমলা বা সবুজ কিনত তো আমি ওকে বেশ করে বোঝাতাম যে রঙিন জিনিস কেন খেতে নেই। এবং শেষের দিকে আর না থাকতে পেরে ওর থেকে খানিকটা কামড়ে নিতাম। ওকেও আমারটা দিতাম, এমনি নয়।
আর একটা কথা, সেসময় ওই বরফ কলের মালিকানা ছিল আমাদের পাড়ারই একটি পরিবারের। গরমকালের বিকেলে যখন ওদের বাড়ির আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা একটা করে জলবরফ হাতে রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরত তখন প্রচন্ড লোভ দিতাম আর হিংসে করতাম। বিশেষ করে ওদের বাড়ির আমাদের সমবয়সী কাউকে এই জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখলে তো ভাবতামই ভাবতাম- "উফ! এদের কি মজা"। এরপর যখন সেই বরফ কলে জলবরফ এর সাথে সাথে 'চিঁড়েবরফ' ও 'বেলবরফ' (জলবরফ সঙ্গে উপরের দিকটা চিঁড়ে বা বেল দেওয়া) তৈরী শুরু হলো তখন তো আমাদের দলে রীতিমত হুলুস্থুল পড়ে গেল। যদিও দ্বিতীয় বিষয়টা আমার বিশেষ প্রিয় না হলেও, প্রথম বিষয়টা আমার কাছে...........উফ, খেতে ইচ্ছা করছে। এবার বাড়ি গিয়ে খাবই খাব।

গাভী: নিশ্চয়ই চমকেছেন নামটা শুনে? জানি তো। সবাই চমকে যায়। ঘটনাটা কিছু নয়। বেশ খানিকটা গুড় বা চিনি কে এমন ভাবে ফোটায় যে একটা চটচটে ভাব চলে আসে। এবার সেটাকে নারকেল বা খেঁজুর পাতার ওপর রেখে হাওয়াতে ঠান্ডা করে শক্ত করে। খেতে গেলে দাঁতে জড়িয়ে যায়। মিষ্টি মিষ্টি এই ব্যাপারটা আমাদের বাড়ির কাছের বাজারে ময়রার দোকানে পাওয়া যায়। বাড়ি গেলেই খাই। দারুন লাগে। কিন্তু এই অপূর্ব জিনিসটার নাম 'গাভী' কেন তা আমি জানি না। অনেক ভেবেও বার করতে পারিনি। হয়ত আপনারা এটিকে অন্য নাম চেনেন, আমি চিনি 'গাভী' নামে। এই বস্তুটি আমি আর কোথাও দেখিনি। এটাও খেতে হবে বাড়ি গিয়ে।

চ্যমন বাহার:  বাড়িতে পান সাজা হলে মা একটুখানি হাতে দিত। এক চিমটে। আর একটু চাইলে বলত "বেশি খেলে মাথা ঘুরবে"। এটাও চুরি করে খেলে স্বাদ বাড়ে বলে আমার ধারণা। কিন্তু ওই মাথা ঘোরার ভয়ে বেশি করে চুরি করতে পারিনি কোনদিন। কিন্তু মুখে দিলেই.......উমমম......।

স্কুল থেকে পাওয়া পাঁউরুটি:
এমনিতে পাঁউরুটি আমার খুব একটা কাছের বস্তু ছিল না। কিন্তু সেসময় আমাদের প্রাইমারি স্কুলে বাচ্চাদের একটা বড় পিস পাঁউরুটি দেওয়া হত রোজ। এক পাউন্ড বড় পাঁউরুটি থেকে কেটে কেটে। এখনকার মিড ডে মিলের ছোট সংস্করণ বলা যায়। সেই পাঁউরুটির পিসটার উপর কেন জানিনা আমার দারুন লোভ ছিল। অনেকেই পাবার সাথে সাথে খেয়ে ফেলত। আমাদের মত কয়েক জন অতিবাধ্য ন্যালা-ক্যাবলা গোছের লোক সেটাকে বয়ে বয়ে বাড়ি নিয়ে আসত। কারণ কাঁচা পাঁউরুটি না সেঁকে খাবার অনুমতি ছিল না। বহু কষ্টে লোভ সংবরণ করে বাড়ি নিয়ে আসতাম, আর অপেক্ষা করতাম কখন মা সেঁকে দেবে। 

পাঁপড়ভাজা রুটি: না না পাঁপড়ভাজা দিয়ে রুটি নয়। অন্য জিনিস। রুটি বানানোর শেষে, শেষ দু পিস রুটি মা বেশ পাঁপড় সেঁকার মত করকরে করে সেঁকে নিয়ে আসত। তারপর দুজন মিলে পা ছড়িয়ে বসে কড়মড় কড়মড় করে সেই পাঁপড়ভাজা রুটি সেবন। আহ, কি যে আরাম। সন্ধ্যেবেলার পড়ার মাঝে ওইসময়টুকু বিশ্রাম। সেজন্যই বোধহয় এত ভালো লাগত জিনিসটা খেতে, কে জানে।

আরো অনেক অনেক স্বর্গীয় খাবার যেমন, তিলের পাটালি.....চিনির লাড্ডু......পাকা তালের নুটি...... তারপর......চিনির মুড়কি.......ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কিছু তো বলাই হলো না। দারুন দারুন সব ব্যাপার। আপনাদের ঝুলিতেও নিশ্চয়ই এরকম সব অপূর্ব খাদ্যবস্তু আছে তাই না? যেগুলো যেকোনো সময়ই খেতে ইচ্ছে করে? জানাবেন আমায়।     

2 comments:

  1. আমার মনে পড়ে স্কুলের সামনের ঘুগনির দোকানটার কথা। একদিন একটা দু'টাকার কয়েন ছিল পকেটে। আশ মিটিয়ে খেয়েছিলাম। আর এক দিন, বর্ষাকালে চারদিক অন্ধকার। ঘরে লাইট জ্বালাতে হয়েছে। স্কুলে যাবার কথা কেউ ভাবেইনি। রেনি ডে। ফেলুদা পড়ছি। আর ক্রিম ক্রাকার বিস্কুট খাচ্ছি। হঠাৎ নাকে এলো ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ। মনমাতানো। ওফ্ !

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর বর্ষার দিনের খিচুড়ি আর ডিমভাজা? আর আমার ঘুগনি খাওয়া হলো বিজয়া দশমীর দিন সন্ধ্যে বেলা। মা বানাত। পারার এক দিদি ওই ঘুগনির জন্য বিজয়ার দিন সবার আগে চলে আসত।

      Delete