Thursday 8 January 2015

অভাবের অভাব না স্বভাবের অভাব

আচ্ছা টাকাপয়সা সম্বন্ধে আপনাদের কি ধারণা? খুব একটা স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও এটুকু না মানলেই নয় যে জীবনধারণের জন্য এই বস্তুটির মত প্রয়োজনীয় আর কিছুই নেই, আবার জীবনযাত্রার শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য এর চেয়ে দক্ষ বস্তুও আর কিছুই নেই। তাই দরকারের বেশি এসব নিয়ে নাড়াঘাঁটা না করাই ভাল। তাই যদিও আমি মনে করি টাকাপয়সা সংক্রান্ত কথাবার্তা যত কম বলা যায় ততই ভাল, তাও টাকাপয়সার অভাবে গরিব মানুষদের কত কষ্ট হয় তার অন্তত দুটি বিবরণ আপনাদের সামনে পেশ করার লোভ আমি সামলাতে পারছি না। ঘটনাগুলি শুনে আপনারাই বিচার করুন এইসব এইসব দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর লোকজনের অভাব দূরীকরণের জন্যে কি করা যায়?

ঘটনা ১

স্থানঃ গুরগাঁও এর ব্যস্ত রাজপথ।

কালঃ সেপ্টেম্বর- অক্টোবর এর কোন একদিন সকাল ১০ টা।

পাত্রপাত্রী ও ঘটনাঃ আমরা দুজন বিনোদ (নাকি ভিনোদ...উফ চিরকালের সমস্যা আমার এই নাম উচ্চারণ) ভাই এর অটো চেপে গুরগাঁও থেকে আমাদের দ্বীপরাষ্ট্রে ফিরে আসছি। দেরী হয়েছে যথেষ্ট। বিনোদভাই যথাসম্ভব তাড়াহুড়ো করে এদিক ওদিক ট্র্যাফিক কাটিয়ে প্যাঁকাল মাছের মতন এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। সাইডের রাস্তা থেকে ফ্লাইওভার এ ওঠার মুখে বিনোদের রথ গেল থেমে। আর শুধু থেমেই গেল না ওই বিখ্যাত জ্যামে ন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে অনন্ত কালের জন্য রাস্তায় গেঁথে গেল। লক্ষ-লক্ষ অটো থেকে শুরু করে মহার্ঘ্য সব গাড়ি প্যাঁ-পোঁ করে নিজের নিজের তাড়াহুড়োর এত্তালা দিতে লাগলো। আর আমরা কিছুক্ষণ দেরী হচ্ছে বলে প্রচণ্ড টেনশন করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে যে যার মতন রামপ্রসাদীতে ফিরে গেলাম। তখনই ঘটলো প্রথম ঘটনা। আমাদের সময়মত পৌঁছে দেবার জন্য বিনোদভাই এর আন্তরিক চেষ্টার অন্ত ছিল না। সে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো প্রায় সত্তর আশি বছরের (মানে তাঁকে দেখে এরকম বয়সীই মনে হচ্ছিল) ট্র্যাফিক পুলিশ মহোদয়কে অনুরোধ করল যে সামনের আর ডানদিকের দুটি গাড়িকে যদি তিনি দয়া করে একটু তাঁর হুইশল এর জোরে এদিক-ওদিক সরিয়ে নড়িয়ে দেন তবে বিনোদ ফ্লাইওভারে না উঠে তার অটোটিকে ব্যাক করিয়ে বামদিকের অন্য রাস্তায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে এবং সে রাস্তা দিয়ে আমাদের সময়মত পৌঁছে দেবার একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারে। এটি কোনও বেআইনি অনুরোধ নয়। অনায়াসেই তিনি সেটি করতে পারতেন। উত্তরে পুলিশদাদু ডান হাতটি বরাভয় মুদ্রায় তুললেন একবার। আমি ভাবলাম বলছেন হয়ত “তিষ্ঠ বৎস ক্ষণকাল, তোমার আবেদন এই আমি মঞ্জুর করলুম বলে।” ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে যাব, দেখি অভিজ্ঞ বিনোদ বলছে “ক্যা তাউ জি? ইসকে লিয়ে ভি ফিফটি? ছোড়িয়ে।” স্বস্তির নিঃশ্বাসটা ক্যোঁৎ করে গিলে ফেলে বুঝতে পারলাম যে পুলিশদাদুর ওই পাঁচ আঙ্গুল-এর মানে বরাভয় না, বরং পঞ্চাশটি টাকা। দুটি গাড়িকে সরিয়ে আমাদের ভিড় থেকে পিছু হেঁটে বেরিয়ে যাবার দাম হিসাবে গরিব পুলিশদাদু পঞ্চাশ টাকা হেঁকে বসেছিলেন।

সেদিন আমরা ওই জ্যামে প্রায় পনের-কুড়ি মিনিট আটকে ছিলাম।        

        
ঘটনা ২

স্থানঃ গুরগাঁও থেকে বেরিয়ে এসে হরিয়ানার গ্রামের পাশে জাতীয়সড়ক।

কালঃ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোন এক ভোর, হাড়হিম করা ঠাণ্ডা হাওয়া। 

পাত্রপাত্রী ও ঘটনাঃ সেদিন দিল্লিতে তাপমাত্রা নাকি ২.৬ ডিগ্রি। আমাদের এই ফাঁকা জাতীয়সড়কের ধারে তাপমাত্রা হয়ত আরও এক দেড় ডিগ্রি কম হবে। নিজেকে আপাদমস্তক আচ্ছা করে সোয়েটার-জ্যাকেট-টুপি-মোজা-মাফলারে মুড়ে চোখ দুটো শুধু বের করে হাত পকেটে ঢুকিয়ে আমাদের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছি আর রাস্তার ধারে তেড়ে পায়চারি করছি মানে গা গরম করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছি। পিনাকী ওরই মধ্যে ক্যামেরা বার করে আকাশ-বাতাস-কুয়াশা-কুয়াশার মাঝে গাড়ি-রাস্তার পাশে আগুন জ্বালিয়ে লোকজনের জটলা এসবের দিকে তাক করছে। মানে ও ওর মতন করে গা গরম করার চেষ্টা করছে (আমি নিশ্চিত ওই ঠাণ্ডায় শৈল্পিক ছবি তোলার দিকে মন থাকার কথা নয়)। সে যাক গিয়ে। ওই যে বললাম না রাস্তার পাশে আগুন জ্বালিয়ে লোকজনের জটলা-এঁরা সকলেই স্থানীয় দোকানদার-ফলওয়ালা-চিনেবাদামওয়ালা ইত্যাদি ইত্যাদি। দোকান খোলার আগে প্রাত্যহিক গল্পগাছা আর আগুন পোহানো চলছে। সেদিকে তাক করতেই সেখান থেকে একজন হঠাৎ ডান হাতটা সটান মাথায় ঠেকিয়ে পিনাকীর দিকে স্যালুট ঠুকে দিল। থতমত খেয়ে পিনাকীও হেসে ডানহাতটা মাথায় ঠেকাল। ততক্ষণে জটলার জনগণ আমাদের বোধহয় প্রচণ্ড ধনী বিদেশি ট্যুরিস্ট ঠাউরে ফেলেছে। যাঁরা ভারতবর্ষের কোনোকিছুই ছবি তোলার অযোগ্য বলে মনে করেন না। তাই শীত-বর্ষা-ভুমিকম্প-বজ্রপাত-জলোচ্ছ্বাস কোনোকিছুই তাঁদের ফটোগ্রাফি থেকে বিরত করতে পারে না। স্বাভাবিক। আমাদের চোখ ছাড়া আর কোনোকিছুই দৃশ্যমান ছিল না আর সেই ঠাণ্ডাতেও পিনাকীর চোখে ক্যামেরা ছিল। সুতরাং দুই এ দুই এ চার করে চার-পাঁচ জন জ্যাকেট-টুপি পরা হদ্দ জোয়ান লোক মুখে একটা বিগলিত হাসি নিয়ে আবার একবার ডানহাত কপালে ঠেকাল, তারপর ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল ঠোঁটে ঠেকাল তারপর ডানহাত সামনের দিকে পেতে দিল।

অর্থাৎ কিনা, “বড্ড ঠাণ্ডা পড়েছে দাদা, এই যে আপনাকে আমাদের ছবি-টবি তুলতে দিলাম তার পরিবর্তে আমাদের গা গরম করার জন্য পানীয়ের টাকাকটা আপনিই দিয়ে যান।” প্রথম ঘটনার পুলিশ দাদু বা এই আগুন পোহানো জটলার লোকজন প্রত্যেকেরই কিন্তু নিজস্ব রোজকারের পথ আছে। সে পথে তাদের জীবনযাত্রার সংস্থানও হয়ে যায়। তাও এই অসুস্থ ভিক্ষাবৃত্তি। অবাক হবার বেশি সময় পেলাম না। আমাদের গাড়ি ততক্ষণে চলে এসেছে। গাড়িতে উঠে ভাবলাম, যতই মঙ্গল তাক করে রকেট ছুঁড়ে বিশ্ব-চরাচরকে তাক লাগিয়ে দাও না কেন বাপু, ভিক্ষুক মনোবৃত্তির আমূল উৎপাটন যতদিন না সম্ভব ততদিন মঙ্গল ওই আকাশেই বিরাজ করবে। এ তো আর অভাবের অভাব নয়, এ যে স্বভাবের অভাব। এ কি আর এতো সহজে দূর করা যায়? তাই না? কি বলেন?

মনে মনে এঁদের মঙ্গল কামনা করে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে ঘন কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাড়াতাড়ি কুয়াশা কাটার কোন লক্ষণ তখনও অবধি ছিল না।

0 comments:

Post a Comment