Friday 10 April 2015

বিছানা-১


বারোটা উনিশস্টেশনের বড়সড় ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখলো জাগরী সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরেছে সে। ঝকঝকে রোদে গরমটাও মোটামুটি ভালই টের পাওয়া যাচ্ছিলো। তখন তো নেশার মতন ঘুরে গেছে। এখন এই রাত বারোটা উনিশে স্টেশনের সিমেন্টের বেঞ্চে সোজা হয়ে বসে থাকতে থাকতে সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে জাগরীর। হাই উঠছে। ঘুমে চোখ জ্বালা করছে। কিন্তু এখনো আধঘন্টা মতন এই যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে তাকে। সেই একটা নাগাদ ট্রেন ছাড়বে। বারোটা পঞ্চাশ এর আগে তো নিশ্চয়ই ট্রেন ঢুকবে না স্টেশনে। টার্মিনাল স্টেশন না হলে এই এক ঝামেলা।বসে থাকো পিঠ সোজা করে কখন ঢুকবে ট্রেন। তাও ভালো শেষ মুহুর্তে বুকিং হলেও এসি তে আপার বার্থ পেয়ে গেছে সে। ট্রেন ঢুকলে শুধু ট্রেনে উঠে চাদর পেতে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তে পারলেই হলো। ট্রেন চলতে শুরু করলে তার আর কোনো অসুবিধা হয়না ঘুমোতে। অনেকের ট্রেনে ঘুম না হলেও জাগরীর কোনো অসুবিধা নেই ট্রেনের দোলানিতে বরং ঘুমটা তার ভালোই হয়। আর আপার বার্থ হলে তো কথাই নেই। কেউ বিরক্ত করার নেই। যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমোলেই হলো। পাহাড়ে বেড়াতে এলে একটা সমস্যা হলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে গাড়িতে ঝিমিয়ে নেওয়া যায়না একটুও। কেবলই পাহাড়ি বাঁকে বাঁকে চলতে চলতে এদিক ওদিক হেলে পড়তে হয়। ফলে তিন চার দিনের ছুটিতে তিন চার জন মিলে পাহাড়ে এসে প্রতিদিনই সকালে চোখ খুলেই দৌড়-দৌড়-দৌড়। তিন চার দিনে এনার্জি একদম তলানিতে ঠেকেছে জাগরীর। তাও স্টেশন থেকে দু মিনিটের হাঁটাপথের দূরত্বে হোটেল পেয়েছিল তারা। ফলে রাত দশটায় হোটেলে ফিরে বারোটা পর্যন্ত বিছানায় পড়ে ছিল সে। সকলে তৈরী হতে ঘুম চোখে বারোটায় বেরিয়ে এসেছে ব্যাগ ঘাড়ে করে রাত একটার ট্রেন ধরতে। এত রাতের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে ঢুলে পড়তে পড়তে সামলে নিলো নিজেকে। জেগে থাকার জন্য এদিক সেদিক তাকাতে শুরু করলো জাগরী। এত রাতে স্টেশন চত্বর প্রায় ঘুমন্ত। তবে রাতের শিফটে যাঁদের কাজ করার কথা তাঁরা ঠিকই করছেন নিজেদের কাজ। স্টেশনে ঢোকার সময় অটোওয়ালারা নিয়ম মাফিক জিজ্ঞাসা করেছে তাদের অটো লাগবে কিনা, তারপর স্টেশনের মেন গেটের সামনে চলছে বালি সিমেন্টের কাজ। সকালে যাত্রী চলাচলের ভিড়ে মূলরাস্তায় সিমেন্টের কাজ করা দুইপক্ষের জন্যই অসুবিধাজনক। এত রাতে যে কোনো রাজমিস্ত্রী কাজ করেন চাক্ষুষ দেখা হয়ে ওঠেনি কোনদিন। আজ দেখলো দুজন রাজমিস্ত্রী মন দিয়ে সারাচ্ছে স্টেশনের ঢোকার মূল রাস্তাটা। স্টেশনের দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধোয়াধুয়ী চলছে বড় বড় জলের পাইপ আর ওয়াইপার দিয়ে। একটিমাত্র চায়ের ষ্টল খোলা তাদের এই একনম্বর প্ল্যাটফর্মে। স্টেশন ম্যানেজার বা অন্য অন্য অফিসগুলিতেও রাতের শিফটের কাজ চলছে। আসলে এ রাস্তায় এই স্টেশনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই পাহাড়ের সমস্ত পর্যটনস্থান বা তীর্থস্থানের সমস্ত যাত্রীকেই পাহাড়ের ঠিক নিচে অবস্থিত এই স্টেশনটি হয়েই যেতে হয়। সুতরাং যাত্রী চলাচলের বিরাম নেই এ স্টেশনে। তারই মধ্যে স্টেশনচত্বরে যে যার মতন ব্যবস্থা করে ঘুমোচ্ছে সারি সারি মানুষ। সেখানে মাঝরাতে ট্রেন থেকে নামা ভোরের অপেক্ষায় থাকা পর্যটক, তীর্থযাত্রীও যেমন আছে তেমনি আছে স্টেশনই যার ঘরবাড়ি এমন বেশ কিছু মানুষ। একই সাথে পরপর সারি দিয়ে চাদর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সকলে। যতক্ষননা চাদর থেকে মুখ বের হচ্ছে ততক্ষণ বোঝার উপায় নেই কে অ্যাডভেঞ্চার লোভী বিদেশী ট্রেকার, কে ভারতবর্ষের দূর গ্রাম থেকে তীর্থ করতে আসা বয়স্ক দম্পতি আর কেই বা নিতান্ত নিরুপায় হয়ে অন্য কোথাও ঠাঁই না পাওয়া স্টেশনে ঘুমোতে আসা ভবঘুরে। পাশে রাখা ব্যাগ ব্যাগেজের ধরন আর ওপরের চাদর বা কম্বলের রোঁয়া কতটা উঠেছে তা দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায় মাত্র। তাই দেখছিল জাগরী।

তার বসার বেঞ্চের ঠিক পাশেই বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা খাবারের দোকান। আর তার ডাস্টবিন। ডাস্টবিনে বড় বড় ইঁদুরের ছুটোছুটি দেখছিল জাগরী। কি ক্ষিপ্রতায় ছোটো ছোটো খাবারের পড়ে থাকা টুকরোগুলো নিয়ে ছোটাছুটি করছে ইঁদুরগুলো। নানান রকম লোকজন যাতায়াত করছে প্ল্যাটফর্মে।বেশিরভাগই তাদের এই ট্রেনের যাত্রী বলে মনে হচ্ছে। তার মধ্যে বিশেষ একজনের দিকে নজর পড়ল জাগরীর। হয়ত পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে অন্য সকলের চেয়ে বেমানান বলেই তাঁর দিকে নজর গেল তার। দূর থেকে তারই দিকে এগিয়ে আসছেন রোগা ক্ষয়াটে চেহারার বৃদ্ধা। পরনে পাহাড়ী মহিলাদের মতই ছোটো ঝুলের সুতির ঘাগরা আর লম্বা ঝুলের ব্লাউজ, আর সবজে রঙের পাতলা ওড়না। মাথায় একটি রঙচটা চাদর ছোটো করে ভাঁজ করে মাথায় রাখা কারণ সেই চাদরটিই একটি নাইলনের ফিতের সাহায্যে ভার বহন করছে পিঠে রাখা একটি বড়সড় বস্তার। বস্তার ওপরে রাখা আরো একটি বিশাল নাইলনের ব্যাগ। মাথায় রাখা ছোটো আরো একটি ব্যাগ আর পিঠের বস্তার ওপরে রাখা নাইলনের ব্যাগটিকে ধরে রেখেছে বৃদ্ধার শীর্ণ ডানহাত। আর সেই ডানকাঁধ থেকেই ঝুলছে আরো একটি মস্ত বড় কাপড়ের ব্যাগ, যার আপাদমস্তক জিনিসপত্রে ঠাসা বলে মনে হলো জাগরীর। পাহাড়ী মানুষদের ফুসফুসের জোর বেশি হয় শুনেছে সে, কিন্তু তাবলে এই বয়সে চার-চারটে এই সাইজের ভারী ব্যাগ কি করে বৃদ্ধা বয়ে আনছেন বিস্ময়ের সাথে সেটিই লক্ষ্য করছিল জাগরী। সে নিজে এই কম বয়সে একটি মাত্র মাঝারি মাপের ব্যাকপ্যাক হোটেল থেকে স্টেশন পর্যন্ত বয়ে নিয়ে এসেই হাঁপিয়ে উঠেছে। আর পিঠ বা কাঁধের প্যাডিং জাতীয় নূন্যতম আরামের আয়োজন ছাড়াই তার চেয়ে অন্তত দেড়গুণ বেশি ভারী চারটে ব্যাগ একসাথে একজন বৃদ্ধা মহিলা কি করে বয়ে আনতে পারেন এই বিস্ময়টি থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছিল না সে। তার বেঞ্চের ঠিক পাশেই খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে এসে বৃদ্ধা একে একে নামালেন চারটে ব্যাগ। বৃদ্ধা যে এই চারটি ব্যাগ নিয়েই সর্বত্র যাতায়াত করেন সেটা ব্যাগ নামানোরও পারম্পর্য থেকেই বোঝা গেল। কোনো তাড়াহুড়ো ছাড়াই প্রথমে মাথার ছোটো ব্যাগটি নামালেন তিনি। তারপর কাঁধের কাপড়ের ব্যাগ তারপর পিঠের বস্তার ওপরে রাখা নাইলনের ভারী ব্যাগটি। সেটি নামাতে বেশ কষ্টই হলো বোঝা গেল বৃদ্ধার। সবশেষে নাইলনের ফিতে সহ বস্তাটা। বস্তাটি বিশেষ ভারী নয় বোধহয়। ঘুম তাড়ানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিলনা জাগরীর। ডানদিকে তাকিয়ে বৃদ্ধাকে আর তাঁর কার্যকলাপকে লক্ষ্য করতে লাগলো সে।  



        

0 comments:

Post a Comment