Thursday 17 July 2014

লোহাঘাট-মায়াবতী-৩.........আজ মায়াবতী

কাল তো Abbott মাউন্টের গল্প বলেছি আপনাদের। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখি KMVN বাংলোতে তো হই-হই, রই-রই কান্ড। বাংলোর সামনে প্যান্ডেল, স্টেজ, কার্পেট, চকচকে ফ্লাড লাইট, সার সার গাড়ি। ক্যালোর ব্যালোর। পেয়াঁজ-রসুনওয়ালা ভালো ভালো খাবারের গন্ধ। আর ভেতরে অজস্র রংবেরঙের বাচ্চা। সঙ্গে বাবা মায়েরাও আছেন। মায়েরা চুমকি আর পাথর বসানো গাঢ় সবুজ- টুকটুকে লাল-কমলা-চোখ ঝলসানো গোলাপী-বেগুনি রঙের শাড়ী, কনুই পর্যন্ত ঝুমঝুমি লাগানো চুড়ি, নাকে নথ পরে মহা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাবারাও ততোধিক সজ্জিত। গত দিন সকালে ফোনে টিকরাম সিং জী যে বলেছিলেন "কাল তো বারাতওয়ালী পার্টি হ্যায়"। সেই চলছে। KMVN বাংলো স্থানীয় বিয়েবাড়ির জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।সেই বিয়ে বাড়ি শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। তার মাঝে আমরা দুই মক্কেল আগের রাতে না ঘুমিয়ে-সারাদিন টই-টই করে বেড়িয়ে ঝোড়ো কাকের মত চেহারা নিয়ে যখন গাড়ি থেকে নামলাম, তখন "আইয়ে আইয়ে" বলতে গিয়েও একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বাপ-বাপ বলে সামলে নিলেন। আমাদের অতিথি বলে ভুল করে আপ্যায়ন করতে গিয়েই চেহারা দেখে ভুল ভেঙ্গে গেছে। লোকজন, সাজগোজ দেখতে দেখতে আর ক্রমান্বয়ে অবাক হতে হতে নিজেদের ঘরে গিয়ে কোনঠাসা হলাম।

বহুবারের চেষ্টায় টিকরাম সিং জী-কে খুঁজে পেয়ে চা খাওয়াতে বলে ঘরে এসে বসলাম। আর বারান্দা দিয়ে লোকেদের বিয়েবাড়ির জাঁকজমক দেখতে থাকলাম। মনে মনে ইচ্ছে ছিল যে বিয়ে শুরু হলে নিচে গিয়ে দেখব। নাই বা থাকলো গোলাপী রঙের শাড়ী - ঝুমঝুমি চুড়ি - নথ। নাহয় জিন্স-টিশার্ট পরেই যাব, আমার অত লজ্জা টজ্জা নেই বাবা। কাউকে চিনি না তো কি হয়েছে? দেখব পাহাড়ী বিয়ে। নাচা-গানা হলে একটু নেচেও নেওয়া যাবেখন। আর নাচ-টাচ করলে নিশ্চয়ই চক্ষুলজ্জার খাতিরেও একবার কেউ না কেউ পেছনের বাগানে বিশাল প্যান্ডেল করে সকাল থেকে যে চার-পাঁচ জন রন্ধনশিল্পী তাঁদের শিল্পের নমুনা প্রদর্শন করে চলেছেন তার যত্সামান্য রসাস্বাদন করে যেতে বলবেন। এই ফাঁকে বিয়েবাড়ির ভোজ খাওয়াটাও হয়ে যাবে। তাই পিনাকী ঘরে বসে আইপিএল-এ মগ্ন থাকলেও আমি ওসব ফালতু জিনিসে মন না দিয়ে বারান্দা দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারাতেই বেশি উত্সাহী ছিলাম। কিন্তু বর বা বরযাত্রী আসার তো কোনো লক্ষণই দেখলাম না।

রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে করে শেষে রাতের খাওয়া খেয়ে টিকরাম সিং জীকে ব্রেকফাস্টের মেনু বলে শুয়ে পড়লাম। তখনও বিয়ের মন্ডপ ফাঁকা। কি রে বাবা? বিয়ে আজই তো নাকি? নানা রকম জল্পনা কল্পনা করতে করতে তো ঘুমিয়েই পড়লাম। ফাঁকে-ফোঁকরে বিয়ের ভোজটাও জুটলনা কপালে। এ আমি চিরদিন দেখে আসছি, ফ্রি তে কোনো কিছু আমার জোটে না। লোকে এটা কিনলে ওটা ফ্রি, সেটা কিনলে সারপ্রাইজ গিফট-কতো কি পায়। আমার বেলায় সারপ্রাইজ গিফটের মোড়ক খুলে গিফট এর বহর দেখে এত সারপ্রাইজড হতে হয় কি বলব। তা এহেন ফাটা কপালে কি করেই বা আর ফ্রি তে বিয়েবাড়ির ভোজ জুটবে? বিয়ে শুরু হলে আমি যেতামই যেতাম নিচে। পিনাকী না গেলে আমি একাই যেতাম। কিন্তু কি আর করব? কপালে ঘি না থাকলে আমি আর কত ঠকঠক করব? কপালে যে কি ছিল তখন তার আভাস পাইনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বারান্দায় শেষ বারের মত উঁকি মেরে, কম্বলমুড়ি দিয়ে "ঘুমিয়ে পড়ি বাবা" বলে শুয়ে পড়লাম, কাল আটটায় মায়াবতী যাব।

কিন্তু মারে হরি রাখে কে? শুয়ে পড়লেই কি সকাল হয় সবসময়? আমারও হয়নি। লোহাঘাট পৌঁছে বাস স্ট্যান্ড থেকে দশ মিনিট হেঁটে KMVN বাংলোয় এসে পৌঁছেছিলাম সেটা আপনাদের বলেছিলাম। কিন্তু যেটা বলিনি সেটা হলো- দশ মিনিট কি আর খালি খালি হাঁটবো পিঠে ব্যাগ নিয়ে? এই ভেবে পিনাকীর হাজার বারণ সত্বেও লোহাঘাট বাজারের রাস্তার ধারের দোকান থেকে আড়াইশ গ্রাম গরম জিলিপি লোভে লোভে প্রায় একাই খেয়েছিলাম, আর তারপর দুপুরে চিকেন কারি (দারুন ভালো স্বাদ আর দারুন ভালো ঝাল) এবং সঙ্গে সঙ্গতে বিচ্ছিরি স্বাদের খাবার জল। জল আমরা বাইরে গেলে কিনেই খাই। কিন্তু সেদিন বোধহয় কোনো পূর্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার কথা লেখা ছিল কপালে তাই জল কেনা হয়নি। রাত দুটো নাগাদ আমার পেটে কত্থক নৃত্য শুরু হলো। শুরু তো হলো কিছুতেই আর শেষ হয়না। গোটা তিনেক ওষুধ পড়ে গেল, আমার একার এবং সাথে একবিয়েবাড়ি লোকজনের সৌজন্যে বাথরুমের কলে জল শেষ হয়ে গেল এমন কি ভোর রাত্রে ঢোল বাজিয়ে গান গেয়ে গেয়ে বিয়েও শেষ হলো। শেষ হলো না শুধু আমার পাপ। যাই হোক কোনক্রমে ভোর হলো। টিকরাম সিং জী কে বলে বাথরুমে জলের ব্যবস্থা করে, তার আনা অমৃতসম ব্রেকফাস্ট-এর দিকে করুন দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মায়াবতীর জন্য বেরোলাম দশটা নাগাদ।

মায়াবতীতে অদ্বৈত আশ্রমে কি আছে, কেন গেছি এসব আর বলছি না। যেকোনো ট্রাভেল গাইড বা গুগলকে জিজ্ঞাসা করলেই বলে দেবে। আমি বরং আপনাদের কয়েকটা ছবি দেখাই। সেদিন আমার বেশি নড়াচড়া করতে ইচ্ছে করছিলো না আর ভারী ক্যামেরা বইবার মত শারীরিক ক্ষমতা ছিল না, তাই টলতে-টলতে মোবাইলে তোলা কতগুলো সোজাসাপটা অশৈল্পিক ছবি দেখাই।

মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম
আশ্রমের প্রেস ও ডাকঘর ভবন, এখান থেকেই আশ্রম প্রকাশনীর বই পত্র বিক্রি হয় নামমাত্র দামে। আমরা তিনশ টাকায় আটটা বই কিনেছিলাম।
এই যে সেসব বই, আপনাদেরকে দেখাতে শ্রীমান পিনাকীচরণ আমায় এই ছবিটি তুলে দিল এখুনি।
 আশ্রম চত্বরের পশ্চিমমুখো ব্যালকনিটা দারুন। নিচে একপাহাড়ভর্তি আদিম জঙ্গল। দেখলেই মনে হয় এখুনি ডাইনোসর বেরিয়ে আসবে। আগের দিন Abbott মাউন্ট-এর ওই কেয়ার টেকার ভদ্রলোক বলছিলেন যে এখনও নাকি নিচে থেকে চিতা উঠে আসে মাঝে মাঝে। তখন কথাটা বিশ্বাস হয়নি পুরো মাত্রায়। এখন এই জঙ্গল দেখে তো মনে হচ্ছে হতেও পারে। দেখুন একবার।



আর আশ্রমে তো অজস্র ফুল। বাগান দেখে তো আমি আপ্লুত। মায়ের জন্য মন খারাপ করছিল। মা এত বাগান-ফুল ভালোবাসে, এখানে এই ফুলের সমাহার দেখেতো আনন্দে নাচত বোধহয়। আমি তাই ওই লটকে পড়া শরীর নিয়েই মাকে পরে বাড়ি গিয়ে দেখাতে হবে বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুলের ছবি তুলতে লাগলাম বিভোর হয়ে । এমনি পাগলের মত ছবি তুলছিলাম যে আশ্রমের এক মহারাজ তো আমায় হাসি মুখে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন , "এত ফুলের ছবি তুলে কি হবে?" আর আমি যথারীতি হটাত করা প্রশ্নে ভেবলে গিয়ে হেঁ হেঁ করা ছাড়া আর কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। আপনারাও দেখুন পাগল করা বাগান কিনা? এই যে কিছু ছবি।














তারপর বিবেক লেক দেখে, দুপুরে আশ্রমে পঞ্চব্যাঞ্জন দিয়ে ভাত খেয়ে (পেটের কথা ভুলে গিয়ে), অযাচিত ভাবে আলাপ করে প্রায় দু ঘন্টা আমাদেরকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা তিলকমহারাজের আশির্বাদ ও অমুল্য সঙ্গ পেয়ে মনে একটা তূরীয় ভাব নিয়ে ফিরে এলাম লোহাঘাট KMVN বাংলোতে।

বিকেল তিনটে নাগাদ পিঠে ব্যাগ নিয়ে ফের যখন শেয়ার জিপ ধরব বলে লোহাঘাট বাজার এর দিকে হেঁটে আসছি, হটাত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির ভেতর থেকে চেনা গলায় যে যেন বলে উঠলো, "যা রাহে হ্যায় ম্যাম? হ্যাপি জার্নি। "দেখি আমাদের গত দুদিনের গাড়ির ড্রাইভার নবীন (বা নাভিন)। মায়াবতীর ওই ঘোর আর মনের তূরীয় ভাবটা বোধহয় তখনও কাটেনি। দুম করে তার "হ্যাপি জার্নি"-র উত্তরে ক্যাবলার মত বলে ফেললাম, "হ্যাঁ, হ্যাপি জার্নি" । কত আর বলব নিজের ক্যাবলামির কথা।

এই হলো মোটামুটি আমাদের লাস্ট মায়াবতী ভ্রমনের অমূল্য অভিজ্ঞতা। ওহ, আরো একজনের কথা জানিয়ে রাখি। মায়াবতী আশ্রমে তিলক মহারাজ ছাড়াও আরো একজন আমাদের সাথে যেচে আলাপ করেছিলেন। তিনি একজন কবি। এবং তার পর থেকেই আমি উদীয়মান কবিদের দেখলে শত হস্ত দূরে থাকার চেষ্টা করে থাকি। তাঁর কথা অন্য কোনো একদিন অনেক সময় নিয়ে গুছিয়ে বলা যাবে। মহাপুরুষদের কথা কি আর যেমন তেমন ভাবে বলা যায় বলুন?

0 comments:

Post a Comment