Monday 23 February 2015

সার্কাস-৪....শেষ পর্ব

সার্কাস-১, সার্কাস-২ এবং সার্কাস-৩ এরপর........




চারপাশে বরফ, দূরে পরিস্কার কিন্নর কৈলাস পর্বতমালা, আর শান্ত নীল আকাশ। এই হলো ফাগু। আমরা কুফরী থেকে মিনিট দশেকের মধ্যেই ফাগু এসে যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যা নামছে। আর বরফে মোড়া হিমাচলপ্রদেশের সরকারী পর্যটকনিবাসের যেরকম অবস্থান ও সৌন্দর্য, শুধুমাত্র এই পর্যটকাবাসে দুটো দিন শান্তিতে কাটাবো বলেই ফাগুতে আসা যায়। আমাদেরও প্রাথমিক মনোভাব ছিল এটাই। ভেবেছিলাম মাঝের দিনটায় একটু শিমলাতে ঘোরাঘুরি করা যাবে। মাঝে কুফরীটা অতিরিক্ত পাওনা। ফাগুর অবস্থানটা এরকম যে শিমলা থেকে নারকান্ডার রাস্তায় এই ফাগুর পর থেকেই রাস্তাটি নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। ফলে ফাগুর পরে আর বরফ নেই। আমরা ওই সন্ধ্যায় আমাদের সামনের দুই দিনের অস্থায়ী অবস্থান দেখে আগের দিনের ক্লান্তি, সদ্য ক্যামেরার ব্যাটারি হারানোর দুঃখ সব ভুলে গেলাম। হোটেলে ঢোকার রাস্তা-হোটেলের ঢালু ছাদ, সামনে-পিছনের চত্বর পুরু বরফে ঢাকা। আর ভেতরে হিমাচল পর্যটন এর উষ্ণ অভর্থনা। হোটেলের রিসেপশনে বড় করে লেখা আছে "No one can serves you Himachal better than us" কথাটি যে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনী দেখনদারি নয় সেটা হোটেলে ঢোকার সাথে সাথেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম। বড় বড় কার্পেট মোড়া ঘর, যেমন সরকারী গেস্টহাউসে হয়। কিন্তু এখানকার সবচেয়ে বড় পাওনা হলো ঘরের একদিকের দেয়াল জোড়া মস্ত কাঁচের জানলাটা। সেখান দিয়ে নিচে তাকালে পুরু বরফে মোড়া উঠোন। সেখানে সুন্দর চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা। চাইলে রোদে পিঠ দিয়ে, মোটা বরফের ওপর পা দিয়ে বসে প্রাতরাশ সেরে নেওয়া যায়।সোজা তাকালে ঝকঝকে কিন্নর-কৈলাস। আর ওপরে তাকালে মন ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া চকচকে নীল আকাশ। শুধু এককাপ কফি হাতে এই জানালাটির সামনে বসে থাকাটাই আমার কাছে যথেষ্ট কারণ আবার শীতকালে ফাগু আসার জন্য।



পরদিন সকালে চকচকে রোদে আমরা বেরোলাম চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে। তুষারশুভ্র কথাটার আক্ষরিক অর্থ বোধকরি হিমালয়ের এরকম ছোটখাটো গ্রামে আসলেই একমাত্র বোঝা যায়। চোখ ঝলসানো শুভ্রতা। আমাদের কোনো আইস বুট ছিল না। নিজেদের জুতোর মায়া ছেড়ে ঝুরো বরফে পা ডুবিয়ে হোটেলের পাশের রাস্তা দিয়ে উঠলাম অনেকটা। চারিদিক সাদা। আর ফাগু বাসস্ট্যান্ডের পর থেকেই দূরে যে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে সেখানে গিয়েই বরফ শেষ। ওপরে উঠে চারিদিকটা দেখে আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম দূরের শুভ্রবসন হিমালয়ের দিকে চেয়ে। সিমলার পরে যে দেওদারের জঙ্গল শুরু হয়েছিল, ফাগুতেই তার শেষ। আমাদের বামদিকে ঘন জঙ্গল আর ডাইনে পরিষ্কার আকাশে হিমালয়। মাঝে সাদা মেঘের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের জঙ্গমতা ঘোষণা করছে একলা একটি দেওদারের চূড়া। অদ্ভূত এক শিথিলতা আর শান্তি চারি দিকে। জানিনা সঠিক ভাবে ধ্যানমগ্নতা কাকে বলে। কিন্তু সেদিন সেই চকচকে রোদে সব মলিনতা গেছিল কেটে। চারিদিকের শুভ্রতার ছোঁয়া লেগেছিল মনে। আর উতল হাওয়ায় আকাশী রঙের আকাশে ঘন সবুজের সেই একলা দেওদারটি আমার মনে রেখে গিয়েছে চিরকালীন এক মুক্তির সাক্ষর। সবটুকু পরিপূর্ণতা পেল যখন সেই আকাশে উড়তে শুরু করলো একটি পাখি। হতে পারে পাহাড়ি চিল। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, সেদিনের সেই দেওদার আর দূরের হিমালয় এর দৃশ্যটি আমার কাছে অমলিন রয়ে যাবে আমার জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত।








 আমাদের সেদিন শিমলা যাবার কথা। অনিচ্ছা সত্বেও নেমে এলাম নিচে। আলগা বরফে গোড়ালি পর্যন্ত ডুবিয়ে ওঠানামা করেছি। অবিলম্বে বরফ না ঝেড়ে ফেললে এ যাত্রায় নিয়ে আসা একমাত্র জুতোটি যাবে ভিজে। দুজনে নিঃশব্দে জুতোর বরফ ঝাড়তে থাকি। ঘোর লেগেছিল মনের মধ্যে দুজনেরই। 

বারোটায় আমরা বেরোলাম সিমলার উদেশ্যে। ফাগু যেহেতু শিমলা-নারকান্ডা জাতীয় সড়কের ওপরেই অবস্থিত সুতরাং নারকান্ডা, রামপুর, সাহারান থেকে আসা সমস্ত বাসই ফাগুর ওপর দিয়ে শিমলা যায়। তাই আমাদের হোটেলের বয়স্ক রিসেপশনিস্ট আমাদের গাড়ি না নিয়ে বাসে যেতেই পরামর্শ দিলেন। গাড়িতে এখান থেকে শিমলা যেতে অন্তত বারোশ টাকা নেবে। আমরা দাঁড়ালাম বাসের জন্য, পেয়েও গেলাম তাড়াতাড়ি। সিটে গুছিয়ে বসে একটু এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই কুফরী এসে গেল। দেখলাম সামনে একটু একটু করে গাড়ির ভিড় বাড়ছে। তখনও কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এটিই ছিল আমাদের এবারের শিমলা ফাগু ভ্রমনের শেষ দুর্ভোগ। আধঘন্টা ধরে বোধহয় দশ-কুড়ি মিটার এগিয়েছি কি না কে জানে? আমরা দুই পর্যটক একবাস ভর্তি স্থানীয় লোকের মধ্যে হংস মধ্যে বক যথা হয়ে উশখুশ করতে লাগলাম। এখানকার স্থানীয় লোকজন যাঁরা বাসে ছিলেন তাঁরা দেখলাম সবাই খুবই ধৈর্যশীল। হয়তো পাহাড়ে থাকতে থাকতে ধ্বস ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করার অভ্যাস তৈরী হয়ে যায় প্রথম থেকেই। মনে মনে অধৈর্য হলেও বাইরে তার বিশেষ প্রকাশ দেখলাম না। ক্রমশঃ সেই আধঘন্টাটা একঘন্টা-দেড়ঘন্টা ছাপালো। আমাদের বাস অগুন্তি ছোটো গাড়ির সমুদ্রে সাঁতরে সাঁতরে কোনো মতে একচুল একচুল করে এগোতে লাগলো। আমি অধৈর্য্য হতে হতে শেষে হল ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোলাম, উঠে আবার ঘুমোলাম। আমাদের গাড়ি পাঁচ কিলোমিটারও এগোয়নি। ফাগু থেকে শিমলা মাত্র বাইশ-তেইশ কিলোমিটার রাস্তা। পরদিন ছাব্বিশে জানুয়ারির ছুটির জন্য দিল্লি-পাঞ্জাবের বিভিন্ন শহর-চন্ডিগড় (সঙ্গে বাঙালি তো আছেই) সমস্ত জায়গা থেকে সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে নিজেদের গাড়ি নিয়ে বা গাড়ি ভাড়া করে জনগণ কুফরীতে বরফ দেখতে, মজা করতে গেছে। এই পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তারা শিমলা থেকে কুফরী ঢোকার মুখেই রাস্তার পাশে এত বরফ দেখে উল্লসিত হয়ে রাস্তার দুপাশে যেমন তেমন ভাবে গাড়ি থামিয়ে বরফে হুরোহুড়ি করতে লেগেছে। তাতে করে মাঝে রাস্তার যেটুকু অংশ বাকি আছে তাতে একটি গাড়ি কোনোমতে যেতে পারে কি না পারে। মাঝে মাঝেই সেই ফাঁকটুকুর মধ্যে "বাবান এদিকে আয়, এখানে দাঁড়া সোজা হয়ে" (ছবি তোলা হবে), "গৌতমদা টুপিটা খোল না বস", "রবীন্দর আরতি কে পাস ঠ্যাহারো না", "আরে ভাই সানগ্লাস তো প্যাহান কে পিকচার লো"........ইত্যাদি ইত্যাদিতে ভরে যাচ্ছে। গাড়ির স্রোত আর শেষ হয়না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল বারোটায় ফাগু থেকে বেরোলে একটা নাগাদ সিমলার আপার ম্যালে পৌঁছে যাব। সেখানে কিছু খেয়ে দেয়ে নিয়ে পায়ে হেঁটেই ম্যাল রোড, কালিবাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় দ্রষ্টব্য দেখে আবার পাঁচটা নাগাদ একটা গাড়ি নিয়ে ফাগু ফিরে যাব। কিন্তু আমাদের বাস কুড়ি মিনিটের রাস্তা আসতে সময় নিল সাড়ে তিন ঘন্টা। পৃথিবীর সমস্ত গাড়ি বোধহয় কুফরীতে আজ। পরে শুনেছিলাম কুফরীতে সেদিন পুরো পঁয়ত্রিশ হাজার গাড়ি ঢুকেছিল। এটি একটি রেকর্ড। বর্ষশেষের ছুটিতেও এত ভিড় হয়নি কুফরীতে।আমরা সাড়ে তিনটে নাগাদ শিমলা শহরে ঢুকতে পারলাম। আমার এক দিদি গল্প করেছিল, তার বিয়ের পরের দিন সন্ধ্যেবেলা নতুন শ্বশুরবাড়িতে তার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু মাত্র একদিনের বউ, বেচারা কথাটা কাউকে বলতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে ব্যাপারটা বর্ণনা করেছিল এরকম ভাবে, "খিদে পেয়ে পেয়ে, খিদে পেয়ে পেয়ে শেষে ঘুমিয়েই পড়লাম।" আমারও সেই অবস্থা। সকাল আটটায় খেয়ে এই বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত আমার মস্তিস্ক আর কাজ না করতে পেরে শেষে ঘুমিয়েই পড়ল। শেষে সেই গাড়ির জঙ্গল আর রাস্তা জুড়ে ছবি তোলার আদেখলামির মিছিল শেষ করে আমাদের বাস শিমলা শহরে তো ঢুকলো। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল সিমলার আপার আর লোয়ার ম্যাল সংযোগকারী লিফ্টের কাছে নামতে। কিন্তু এই বাস তো সেদিকে যাবে না। কোথায় নামব তবে? কথাটা বাসে পাড়তে না পাড়তেই বাস সুদ্ধু লোক হই হই করে মতামত দিতে থাকলো। সকলেই তাদের রাজ্যে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সাহায্য করতে চায়। সে এক বিশ্রী কান্ড। আমরা একবার করে কারো কথা শুনে নামব বলে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। আবার পরক্ষণে অন্য কারো কথা শুনে ফিরে এসে সিটে বসে পড়ি। বাস শুদ্ধু লোক নিজেদের মধ্যে বাকবিতন্ডা করতে থাকে আমাদের কোথায় নামা উচিত সেই নিয়ে। আর আমরা কোলে হাতের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে একবার এর মুখের দিকে আর একবার ওর মুখের দিকে তাকাতে থাকি। তাঁরা সকলে মিলে যেকোনো একটা জায়গায় সহমত হলেই আমরা সেখানে নেমে যাই। শেষে আমারই পার্শ্ববর্তিনী হিমাচলী যুবতীটি আমায় আশ্বাস দেয় যে আমি যেন তাকে অনুসরণ করি, কারণ সে এমন একটি জায়গায় নামবে যেখান থেকে লিফট পর্যন্ত  বাস পাওয়া যায়। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ওমা দেখি শিমলা শহরের ঘর বাড়ি সব ছাড়িয়ে বাস চলেছে তো চলেছে। আরে কোথায় নামব? পুরো শিমলাই তো শেষ হয়ে গেল? লিফট কি শহরের বাইরে নাকি? সে আশ্বস্ত করলো আমাদের নামতে হবে 'ছোটো শিমলা' বলে একটি জায়গায়। আসলে আমরা একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁক নিয়ে শিমলা শহরের ঠিক পেছনে পৌঁছিয়ে গেছিলাম। নির্দিষ্ট জায়গায় তার পিছু পিছু নামলাম। সে আমাদের নতুন একটি বাস স্ট্যান্ড দেখিয়ে বলে গেল এখানেই বাস আসবে লিফটের জন্য। বাস প্রায় সাথে সাথেই এলো আর আমরাও দৌড়লাম। পিনাকী সামনের দরজায় উঠেছে। আমিও হাঁকুপাঁকু করে ওর পেছনে ছুটতে গিয়ে দেখি আমি আটকে গেছি। মানে আমার হ্যান্ডব্যাগের চেনের রানারের সাথে আমাদের পূর্ববর্তী বাস থেকে নামা বয়স্ক মানুষটির হাতের একপেটি হিমাচলী আপেলের বাক্সের দড়ি বিশ্রী বেকায়দায় জড়িয়ে গেছে। আপেলওয়ালা উঠতে চান এই বাসের পেছনের দরজায়, আমি উঠতে চাই সামনে। আপেলওয়ালাই শেষে হার স্বীকার করে আমার সাথে সাথে সামনের দরজায় উঠলেন। এদিকে পিনাকীর কাছে বাসের কন্ডাকটর পাঁচ টাকা খুচরো চেয়েছে বাসের ভাড়া বাবদ। তার কাছে না থাকায় পিনাকী আমায় বলছে দিতে। এদিকে আমি তো বাসে ওঠা ইস্তক নিজের ব্যাগকে আপেলের বাক্স থেকে আলাদা করতে পারছিনা। আমি আর আপেলওয়ালা দুজনেই টানাটানি চালিয়ে যাচ্ছি। পিনাকী এর বিন্দুবিসর্গ জানে না। সে বারবার বলছে টাকাটা দিতে। অগত্যা আমি শ্যাম ছেড়ে কুল সামলাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে সিধা আপেলওয়ালার ঘাড়ে। বাসটা মোক্ষম সময় ব্রেক কষেছে। অনেক দুঃখিত টুঃখিত বলে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি ব্যাগ আর আপেলের বাক্স এই রাম ধাক্কার চোটে অবশেষে আলাদা হয়েছে। যাক, যা হয় ভালোর জন্যই হয়। এইসব সেরে দেখি লিফট এসে গেছে। আর আমাদের দুজনের জন্য এই বাসে ভাড়া মাত্র পাঁচ টাকা। মানে দুজনের আড়াই আড়াই টাকা করে। ভারতবর্ষে এত কম ভাড়া আর কোথাও এখনো আছে কিনা জানিনা। বার বার কন্ডাকটরকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিন্ত হলাম যে আমরা কোনো ভাবে ভুল বুঝে কম ভাড়া দিচ্ছি কি না।

এরপর লিফটের টিকিট কেটে লম্বা লাইন দিয়ে দুই ধাপ লিফট বেয়ে উপরে উঠে প্রথমেই পেটপুজো করা হলো। তখন প্রায় সাড়ে চারটে বেজে গেছে। অন্ধকার হতে বেশি দেরী নেই। তাড়াতাড়ি পা চালালাম ম্যালের দিকে। ম্যালে একটি স্থানীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠান চলছিল। কি সুন্দর হিমাচলী লোকসঙ্গীতের সুর। কিন্তু আমাদের হাতে বেশি সময় ছিল না দাঁড়িয়ে শোনার। তাই ম্যালে একটা চক্কর মেরে সিধে চার্চের মধ্যে। সেদিন রবিবার। কয়েকজন সেই বিকেলেও প্রার্থনা করছেন। শান্ত পরিবেশ। কি মনে হলো, চার্চের একটা বেঞ্চে বসে মনে মনে "সরস্বতী মহাভাগে..." করে সরস্বতীর পুস্পাঞ্জলির মন্ত্রটা বলে মনে মনেই প্রজ্ঞার দেবীকে প্রসন্ন হবার প্রার্থনা জানালাম। সেদিন ছিল এই বছরের সরস্বতী পুজোর দিন। বসন্ত পঞ্চমী তিথি। যদিও দিনের শেষে খেয়ে দেয়ে অঞ্জলি, তাও আমার বিশ্বাস আমার অঞ্জলি নিশ্চয়ই পৌঁছেছে দেবীর কাছে।

চার্চ থেকে বেরিয়ে ওল্ড ম্যাল রোড ধরে পড়ন্ত লালচে রোদে হাঁটতে শুরু করলাম দুজনে। অদ্ভূত সব জীর্ণ ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের বাড়ি। কিছু কিছু বসবাসের অযোগ্য এখন। হয়ত সেই ব্রিটিশ আমলের বানানো। মনে হলো কত ইতিহাস এখানে থেমে আছে। সেসব গল্প কথা থেকেই হয়ত বাড়িগুলোর ভূতুড়ে দূর্নামও জুটেছে। কৌতূহলে আরো সামনে থেকে দেখব বলে এগিয়ে গেলাম সেরকমই একটা বাড়ির দিকে। আমাদের দুজনকে কৌতূহলী হতে দেখে আমাদের পিছনে দেখি দাঁড়িয়ে পড়েছে আরো একটি দল। পড়ন্ত আলোয় সত্যিই কিরকম যেন থম মারা ভূতুড়ে লাগছিল বাড়িগুলোকে।          
পরিপাটি ছোট্ট শিমলা কালিবাড়ি দেখে আমরা যখন নিচের লক্কড়বাজার বাস স্টান্ডে নেমে এলাম ততক্ষণে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। ফাগু যাবার বাস কখন আসবে জিজ্ঞাসা করায় জানা গেল, আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সেই কিছুক্ষণটা যে ঠিক কতক্ষণ কেউই তার সঠিক উত্তর দিতে পারে না। আমাদের টেনশন বাড়তে লাগলো। আসতে চার ঘন্টা লেগেছে। যেতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? যে কটা গাড়ি কুফরীর দিকে গেছে সব কটা না হলেও বেশির ভাগই তো ফিরবে। সুতরাং এখুনি যাত্রা শুরু না করলে কুফরী পার হয়ে ফাগু পৌঁছাতে আমাদের মাঝরাত হয়ে গেলেও অবাক হব না। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে ভগবানকে ডাকতে শুরু করলাম। এবার একটা গাড়ি না হলেই নয়। এদিক ওদিক তাকিয়ে গাড়ির খোঁজ শুরু করলাম। দেখলাম ভগবান আমাদের কথা শুনেছেন। নিজে না এলেও একজন দেবদূত পাঠিয়েছেন আমাদের জন্য। আর সেই দেবদূত লক্কড়বাজার বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র অল্টো গাড়ির ড্রাইভার সেজে গাড়ির মধ্যে বসে গুটখা খাচ্ছেন। আমাদের মতন উদভ্রান্ত চেহারা আরো দুএকটা দেখতে পাচ্ছিলাম আশেপাশে। তারা গিয়ে সবেধন নীলমণি গাড়িটিকে নিয়ে ভেগে যাবার আগেই আমরা দৌড়ে গিয়ে পাকড়াও করলাম দেবদূতকে। তিনি এককথায় ন্যায্য মূল্যে আমাদের ফাগু পৌছে দেবার আশ্বাস দিলেন। তার রথে উঠে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলাম। যাই হোক রাত দশটার মধ্যে অন্তত ফাগু পৌছে যাবই।

কিন্তু না আমাদের ভাগ্যে আর কোনো দুর্ভোগ ছিল না সে যাত্রা। অন্ধকার হয়ে যাওয়াতে কুফরীর থেমে থাকা গাড়িগুলো সব চলতে শুরু করে দিয়েছিল। অন্ধকারে তো আর ছবি তোলা যায় না ভালো। তাই রাস্তা আটকে বরফের ওপর বিভিন্ন বিভঙ্গে ছবিতোলার মাতলামিটা ফেরার সময় আর ছিল না। আমরা বেশ মসৃণ গতিতেই উল্টো দিক থেকে আসা কুফরী ফেরত গাড়ির মিছিলের দিকে তাকিয়ে গালাগালি দিতে দিতে আর আমাদের গপ্পে ড্রাইভারের সাথে গল্প করতে করতেই ফিরেছিলাম সেদিন। এই ড্রাইভারও সেদিন যাত্রী নিয়ে কুফরীতে এসে কি ঝামেলায় পড়েছিলেন সেই গল্প শোনাচ্ছিলেন। আমরাও আমোদ করে শুনতে শুনতে আসছিলাম।

হঠাৎই পিনাকী ডানদিকের জানলার দিকে আঙ্গুল তুলে বলল "দেখ দেখ।" দেখি নিচে শিমলা শহরের দীপাবলী আর দিগন্তে আকাশ জুড়ে গাঢ় কমলা রঙের একটা লাইন তৈরী হয়েছে সূর্যাস্ত পরবর্তী আলোয়। ওপরের আকাশ পরোপুরি বেগুনি। একটি দুটি তারা ফুটেছে সেখানে। আমাদের স্তব্ধতায় মুগ্ধতা আন্দাজ করে আমাদের ড্রাইভার বললেন "দাঁড়াব? ছবি নেবেন? ভালো ক্যামেরায় আসবে এই ছবি।" পিনাকীর হাতের ক্যামেরা দেখেই বোধহয় এই মন্তব্য। দুজনেরই গলা থেকে যান্ত্রিক ভাবে একবাক্যে "না" বেরোলো। কিছু কিছু ছবি বোধহয় তোলার চেষ্টা না করাই ভালো। ছবি তুলতে গিয়ে প্রকৃতিদেবীর প্রসাধনী মাখা সেই ক্ষনিকের মুহুর্তটা বুঝি হারিয়ে যাবে এই ভয় হয়। গত আটচল্লিশ ঘন্টায় আমি অমানুষিক ভিড় ঠেলে দিল্লির বাস স্ট্যান্ডে এসেছি। সেখান থেকে তিনটি গাড়ি বদলে সারারাত প্রায় না ঘুমিয়ে গুড়ের নাগরীর মতন টলতে টলতে শিমলা এসেছি। আমার ক্যামেরার ব্যাটারি খোয়া গেছে। সারাদিন জ্যামে রাস্তায় কাটিয়ে বিকেলে শিমলায় ঝটিকা সফর সেরেছি। এত প্রতিকূলতা সত্বেও প্রিয় সাথীর হাত ধরে দেখা ফাগু আমার কাছে কেবলমাত্র সকালের বরফের মাঝে নীল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা একলা দেওদার গাছটি আর এই কমলা পাড় দেওয়া ঘন বেগুনী রঙের শাড়ি পরা সন্ধ্যাটুকুর জন্যেই হয়ত চিরজীবন অমলিন হয়ে থেকে যাবে।ঝিঁ ঝিঁ র ঝিম ধরা শব্দ আর মাঝে মাঝে কুফরী থেকে ফেরা ক্লান্ত ঘোড়া আর তাদের বাচ্চা সহিসদের দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম ফাগু। বাকি রাস্তাটা আমরা কেউ আর কোনো কথা বলিনি সেদিন।

কাল আমাদের ফিরে যেতে হবে।   

 (শেষ)

0 comments:

Post a Comment